মানুষের মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকেই। কত অভিনব পদ্ধতিতেই না মানুষ আকাশে উড়তে চেষ্টা করেছে! কখনো মোমের পাখা, কখনো বেলুন দিয়ে, কখনো আবার বিচিত্র যন্ত্রের পিঠে চড়ে আকাশে উড়ার চেষ্টা করেছে মানুষ। পাখির পিঠে চড়ে আকাশে উড়ার চেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সবগুলোই।
বাস্তবিকপক্ষে মানুষ সর্বপ্রথম সফলভাবে আকাশে উড়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। কিন্তু তা শুধু সীমাবদ্ধ ছিল পৃথিবীর বুকে অর্থাৎ পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। পরবর্তীতে আধুনিক সংস্করণের মাধ্যমে শত-সহস্র বিমান আবিষ্কৃত হয়েছে। যখন মানুষ পৃথিবীর বুকে খুব সহজেই উড়তে সক্ষম হলো তখন স্বপ্ন দেখতে থাকল আরো বেশি। কিভাবে যাওয়া যায় মহাকাশে? ভিন্ন গ্রহগুলোতে, কিংবা মিল্কিওয়ে এর বাইরে অন্য কোন গ্যালাক্সিতে, এই নিয়ে চলতে থাকল চূড়ান্ত গবেষণা।
দশকের পর দশক ধরে মহাকাশযান তৈরিতে বিজ্ঞানীরা যে ঘাম ঝরিয়েছে এবং পরাশক্তিগুলো যে অর্থ খরচ করেছে তা কল্পনাতীত। মহাকাশ জয়ের স্বপ্নের পেছনে সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে পরাশক্তিগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো, পৃথিবীতে যেমন তারা প্রভাব বিস্তারের জন্য শীতল যুদ্ধ অংশ নিল, ঠিক তেমনি কে কার আগে মহাকাশেও নিজেদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করবে তা নিয়ে শুরু হয়ে গেল দ্বন্দ্ব।
মহাকাশ জয়ের এই দ্বন্দ্বে দুই পরাশক্তির মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ায় এগিয়ে ছিল। কেননা তারাই সর্বপ্রথম ১৯৫৭ সালে ‘স্পুটনিক-১’ মহাকাশযান তৈরি করতে সক্ষম হয়। অক্টোবর ৪, ১৯৫৭ তারিখে ১৯:১২ মিনিটে পৃথিবীর বুক থেকে সর্বপ্রথম মহাকাশের উদ্দেশ্যে এ যান পাড়ি দেয় মহকাশে। সে সময় প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে আমেরিকাও গবেষণার জন্য জলের মতো অর্থ ঢালছিল। কিন্তু মাঝপথে সোভিয়েত রাশিয়ার সফলতায় তারা হতবাক হয়ে যায়। স্পুটনিক-১ ২১ দিনে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হয়। যা ছিল মানুষের তৈরি প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ।
এর মাত্র কিছুদিন পরে নভেম্বরের ৩ তারিখে স্পুটনিক-২ মহাকাশে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে মহাশূন্যে লাইকা নামক একটি কুকুর পাঠানো হয়। এটি ছিল মহাকাশে সর্বপ্রথম কোনো জিবন্ত প্রাণের অস্তীত্ব। এর পরে ১৯৫৮ সালে ১৫ই মার্চ স্পুটনিক-৩ মহাকাশে উৎক্ষোপন করে রাশিয়া।
ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা হারভাঙা পরিশ্রম করে তৈরি করে ফেলে এক্সপ্লোরার-১। ১৯৫৮ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি এটি মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হয়। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম মহাকাশ যাত্রায় সফলতা পায়।
যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকবার চমকে দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া এবার মহাকাশে মানুষ পাঠাতে সক্ষম হয়। ‘ইউরি গ্যাগারিন’ সম্পর্কে নিশ্চয় আপনাদের জানা আছে। রাশিয়ান এই নভোচারী ভোস্টক-১ এ চড়ে সর্বপ্রথম মহাকাশ থেকে ঘুরে এসেছেন। আর এই অসম্ভব ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। মাত্র ১ ঘন্টা ৪৮ মিনিটের এক মহাকাশ ভ্রমণে ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্যতম কাজটি সম্পন্ন হয়। ইউরি গ্যাগারিন হয়ে ওঠেন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।
ইউরি গ্যাগারিনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে, আর তা হলো অনেক সময় বিভিন্ন জার্নালে কিংবা লোকমুখে শোনা যায় ইউরি গ্যাগারিন নাকি মহাকাশে যেয়ে বলেছিলেন “আমি এখানে উপরে কোন ঈশ্বর দেখতে পাচ্ছি না।” কিন্তু বেজ স্টেশনের সাথে তার সকল কথোপকথনই রেকর্ড করা আছে। এই সমস্ত রেকর্ড থেকে এমন কোন কথা পাওয়া যায়নি। তবে এমন কথা বলেছিলেন অন্য একজন।
মূলত সিপিএসইউ এর কেন্দ্রীয় মিটিংয়ে এই কথাটি বলেছিলেন নিকিতা খ্রুসচেভ। ধর্মবিরোধী ওই মিটিংয়ের এক পর্যায়ে খ্রুসচেভ বলেন “গ্যাগারিন মহাকাশে ভ্রমণ করলেন, অথচ সেখানে তিনি কোন ইশ্বরকে দেখতে পেলেন না”। তাছাড়া গ্যাগরিন ছোটবেলা থেকেই অর্থডক্স চার্চের ব্যাপিস্ট ছিলেন। তিনি বরং বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ঈশ্বরের দেখা পায়নি, সে কখনই মহাকাশে তার দেখা পাবে না”।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সফলতা পেতেও দেরি হলো না। সোভিয়েতরা মহাকাশে মানুষ পাঠানোর মাত্র কয়েকদিন পরেই ১৯৬১ সালের ৫ই মে আলান শেফার্ডকে মহাকাশে পাঠায় তারা। আলান শেফার্ড ছিলেন দ্বিতীয় নভোচারী যিনি ইউরি গ্যাগরিনের পরে মহাকাশ ভ্রমণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ মহাকাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ জয় ও প্রধান ভূমিকায় ক্রমবর্ধমান রূপে আতঙ্কিত ও হতবাক হয়েছিল। এজন্য ২৫শে মে সেদেশের প্রেসিডেন্ট জন.এফ. কেনেডি ১৯৭০ সালের আগে মানুষকে মহাশূন্যে পাঠানোর ঘোষণা দেন। এতে তিনজন ব্যক্তি নিয়ে অ্যাপোলো প্রোগ্রাম এর সূচনা হয়।
১৯৬২ সালে ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে ইতিহাসের তৃতীয় মনুষ্যবাহী অক্ষীয় মহাকাশ উড্ডয়ন ফ্রেডশিপ-৭ মিশনে পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে। ১৯৬৩ সালের ১৬ই মে পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্র মোট ছয়টি প্রজেক্ট মার্কিউরি মহাকাশচারী উক্ষেপণ করে; একত্রিত অবস্থায় ৩৪ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এবং মহাকাশে ৫১ ঘণ্টা অতিক্রম করে।
এরপর পৃথিবীর প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে ভ্রমণ করেন ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা। তিনি সোভিয়েত মিশন ভস্টক-৬ এর মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের ১৬ই জুন অক্ষে পৌঁছান। সোভিয়েত মহাকাশযানের প্রধান নকশা প্রণয়নকারি সার্জেয় করয়লভ একটি নারী মহাকাশচারী নিযুক্ত করার এবং ভস্টক ৫/৬ এ একই সময়ে নারীকে উৎক্ষেপণের ধারণা দেন। যদিও, তার পরিকল্পনার পরিবর্তন করে ভস্টক-৫ এ একজন পুরুষ এবং পরবর্তীতে তেরেস্কভাকে পাঠানো হয়। তেরিকোভার উড্ডয়নের সময় রাষ্ট্রপতি কুর্সচেভ ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে কথা বলেন।
১৯৬৩ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখে তেরেস্কিভা একজন মহাকাশচারী আন্ড্রিয়ান নিকোলায়েভকে বিবাহ করেন; যিনি ভস্টক-৩ এর মাধ্যমে যাত্রা করছেন। ১৯৬৪ সালের ৮ই জুন, তিনি দুই মহাকাশচারী দ্বারা ধারণকৃত সর্বপ্রথম সন্তানের জন্মদান করেন। ১৯৮২ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং পরবর্তীতে তেরেস্কোভা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী সদস্য হন।
বিমানচালক সয়েভতলানা স্যাভিটিস্কেয়া দ্বিতীয় নারী মহাকাশচারী ছিলেন। তিনি ১৯৮২ সালের ১৮ই আগস্ট সয়োজ টি -৭ যানে যাত্রা করেছিলেন।
১৯৮৩ সালের ১৮ই জুনে স্পেস শাটল এসটিএস-৭ যাত্রা করে স্যালি রাইড যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী মহাকাশচারী হন। ১৯৮০-এর দশকে নারী মহাকাশচারী একটি সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে।
আরো পড়ুনঃ
আলোর গতি এবং বিজ্ঞানীদের মতবিরোধ
নাসা
নাসা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। National Aeronautics and Space Administration (NASA) হলো যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও মহাকাশ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে।
প্রজেক্ট মার্কিউরি
প্রোজেক্ট মার্কিউরি হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মনুষ্যসমৃদ্ধ মহাকাশ উড্ডয়ন প্রোগ্রাম, যা ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। এটির উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্বে পৃথিবীর অক্ষে মানুষকে পৌঁছানো এবং সুরক্ষিতভাবে ভূমিতে ফিরিয়ে আনা। জন গ্লেন প্রথম মার্কিন যিনি মহাকাশে গমন করেন। মার্কিউরি অ্যাটলাস-৬ বাহনে করে ১৯৬২ সালের ২০ই ফেব্রুয়ারি তিনি পৃথিবীকে আবর্তন করেন।
প্রোজেক্ট জেমিনি
প্রোজেক্ট জেমিনি নাসার পরিচালিত দ্বিতীয় মনুষ্যসমৃদ্ধ মহাকাশ উড্ডয়ন প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামটি ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। এই প্রোগ্রামটি মহাকাশে আশ্রয়ের জন্য পথ প্রদর্শক ছিল। ১৯৬৫ সালের ৩রা জুন জেমিনি+৪ মিশন চলাকালীন এড হোয়াইট সর্বপ্রথম যানবাহন বহির্ভুক্ত কর্মকান্ড(ইভিএ) সম্পাদন করেন।
অ্যাপোলো প্রোগ্রাম
অ্যাপোলো প্রোগ্রাম নাসা দ্বারা পরিচালিত তৃতীয় মনুষ্যসমৃদ্ধ মহাকাশ উড্ডয়ন প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হিল চাঁদকে প্রদক্ষিণ করা এবং চাঁদের ভূপৃষ্ঠে মনুষ্যসমৃদ্ধ বাহন অবতরণ করা। এই প্রোগ্রামটির সময়কাল হলো ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২।
স্কাইল্যাব
স্কাইল্যাব প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল নাসার সর্বপ্রথম স্পেস স্টেশন তৈরি করা। এই প্রোগ্রামটি ১৯৭৩ সালের ১৯ই মে স্যাটার্ন V রকেটের সর্বশেষ উৎক্ষেপন চিহ্নত করে।
স্পুটনিক
১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর স্পুটনিক-১ পৃথিবীর সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হয়। কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি রেডিও সংকেত প্রেরণ করে,এছাড়া কোনো সেন্সর ছিল না। স্পুটনিক-১ গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম উপগ্রহটির অবস্থান ও বেগ পরিমাপ করে বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে এটির টান(ড্র্যাগ) গণনা করেন।
ভস্টক
ভস্টক প্রোগ্রাম হলো সোভিয়েত নাগরিকদের পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে উৎক্ষেপণ ও সুরক্ষিতভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বপ্রথম সোভিয়েত মহাকাশ উড্ডয়ন প্রজেক্ট। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত এই কর্মসূচি ৬টি মনুষ্যসমৃদ্ধ মহাকাশে উড্ডয়ন পরিচালনা করে।
এক সময় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে মহাকাশ গবেষণা চললেও বর্তমানে বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে মহাকাশ অনুসন্ধান পরিচালিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী বর্তমান রাশিয়ার উচ্চ সম্ভাবনা থাকলেও তাদের অর্থের অভাব। এটির নিজস্ব মহাকাশ কর্মসূচীসমূহ নানান কার্যকলাপ সম্পাদন করে যেগুলোর মধ্যে সামরিক প্রকৃতি অন্তর্ভুক্ত।
This is a Bengali article. It’s about future space project and research.
All the reference are hyperlinked within article.
Featured Image: Getty image