লিখুন
ফলো

সৌরজগতের সীমানা ও সূর্যের প্লাজমার আদ্যোপান্ত

সূর্য আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় সাতাইশ হাজার আলােকবর্ষ দূরে অরায়ন নামক বাহুতে রয়েছে। সূর্য ২২৫-২৩০ মিলিয়ন বছরে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসে। সূর্য প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫১ কিলােমিটার বেগে সামনে এগিয়ে চলছে। আমাদের ঘর বাড়ির ছাদ হােক না সেটা খড়, টিন কিংবা কনক্রিটের, তা আমাদের ঝড়, বৃষ্টি, রােদ, বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। তেমনি, আমাদের সৌরজগতের বাইরে চারিদিকে বিশালাকার একটি অংশ আছে যা আমাদের মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করছে।

সৌরজগত
সৌরমণ্ডল; image source: wikimedia

আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কথাই ধরা যাক। এখানে পাঁচটি আবরণ আছে। এর মধ্যে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে আছে সবার পরিচিত ওজোন স্তর । যা আমাদেরকে ক্ষতিকর আলট্রা ভায়ােলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করছে। এই স্তরগুলাে পৃথিবীর জন্য ছাদের ভূমিকা পালন করে। সৌরজগতের এমন ছাদের নাম হেলিওস্ফিয়ার।

সূর্য আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে প্রায় সাতাশ হাজার আলােকবর্ষ দূরে অরায়ন নামক বাহুতে রয়েছে। সূর্য ২২৫-২৩০ মিলিয়ন বছরে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসে। সূর্য প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫১ কিলােমিটার বেগে সামনে এগিয়ে চলছে।



সূর্য থেকে প্রতিনিয়ত চার্জিত কণা তথা প্লাজমা সৌরজগতের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এই কণাসমূহ চলে সুপারসনিক বেগে (শব্দের চেয়ে বেশি বেগে)। অতিবেগুনি রশ্মিতে দেখলে বােঝা যায়, কত বেশি, কত দ্রুত এই কণা সমূহ সৌর জগতে ছড়িয়ে পড়ছে। একটিউদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ধরেন, আকাশ হতে প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। আর একই সময় একটি বড় বস্তু আকাশে স্থির হয়ে আছে। তাহলে একজন দর্শকযদি ঐ বক্সটার উপর বৃষ্টির পতন দেখে, সে কেমন দেখবে? ঠিক তেমনি বৃষ্টির চেয়ে আরও দ্রুত, ঘনত্বপূর্ণ চার্জিত কণা পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে বিস্মিত হতে হয়।

এর প্রভাব থেকে পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর জীবকূলকে রক্ষা করছে। এই ঘটনাকে বলা হয় সৌর বায়ু প্রবাহ। বলতে পারেন, সূর্যে আবার বায়ু আছে নাকি? বায়ু বলতে আমরা শুধু বাতাস তথা অক্সিজেনকেই মনে করি। কিন্তু বায়ু হল যে কোনাে গ্যাস বা চার্জিত কণার প্রবাহ। সুতরাং সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ২৫১ কিলােমিটার বেগে ছুটতে ছুটতে সেকেন্ডে ৪০০-৮০০কিলােমিটার বেগে চার্জিত সৌর বায়ু সৌর জগতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই তথ্য দিয়ে একটি কল্পনার ছবি হৃদয়ে এঁকে ফেলুন। পরবর্তীতে বুঝতে সহজ হবে।

সৌরমণ্ডলে বিভিন্ন গ্রহাণুপুঞ্জের অবস্থান; image source: wikipedia

এক কথায়, সূর্য সৌর বায়ু স্প্রে করতে করতে সেকেন্ডে ২৫১ কিলােমিটার বেগে এগিয়ে চলছে। আবার মহাশূন্যে সূর্যের মতাে আরও অনেক নক্ষত্র আছে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আছে কয়েক বিলিয়ন কোটি নক্ষত্র। বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যকার পরিবেশ তথা মাধ্যমকেআন্তঃনাক্ষত্রিক (interstellar medium) বলা হয়। এই নক্ষত্রসমূহও, তারাও বিভিন্ন কণার বিকিরণ, প্রবাহ,মহাজাগতিক রশি আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে প্রচন্ড বেগে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহ আমাদের সৌরজগতের উপর চাপ প্রয়ােগ করে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। কিন্তু সূর্যের সৌর বায়ু প্রবাহ দ্রুত বেগে প্রবাহিত হয়ে এই আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের চাপকে প্রতিহত করে। এই ঘটনা সৌর জগতের চারপাশেই ঘটে থাকে। সৌর বায়ু প্রবাহ নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহকে বাধা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের প্রবাহের ক্রিয়ায় ধীরে ধীরে কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায়। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, সূর্য নির্দিষ্ট বেগে সামনে ছুটতে ছুটতে নির্দিষ্ট বেগে সৌর বায়ু নিক্ষেপ করছে এবং একই সাথে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যেমে থেকে চার্জিত কণা সূর্যের দিকে ছুটে আসছে তাহলে কেমন পরিবেশ তৈরী হবে, ভাবতে পারেন?



এটা স্রোতের বিপরীতে একটি নৌকার গতির মতাে। কিংবা স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলা সাবমেরিনের মতাে, তাই না? যেখানে, নৌকার উপর-নিচে, ডান-বাম সব দিক দিয়ে পানি সরে যাচ্ছে। এই ঘটনা গ্যাসীয় মাধ্যমে ঘটলে চিত্রটা কেমন হবে? তখন সূর্যের চারপাশে বিশালাকার বুদবুদের মতাে একটি পরিবেশ তৈরি হবে। ঠিক দেখতে ডিমাকৃতির লেজ যুক্ত বুদবুদের মতাে। এটিই মূলত হেলিওস্ফিয়ার নামে পরিচিত। বলতে পারেন, হেলিওস্ফিয়ারের আকৃতি বুদবুদের মতাে গােলাকারই হবে। কিন্তু এর আকৃতি সুষম গােলাকার নয়।

আপনারা চিত্রটি লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন। হেলিওস্ফিয়ার বিভিন্ন প্রসারিত অংশ নিয়ে গঠিতআমরা এই অঞ্চলসমূহ নিয়ে আলােচনা করব। ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ তারিখে নাসা ঘােষণা করে যে, ২৫ আগষ্ট, ২০১২ তে ভয়েজার-১ হেলিওস্ফিয়ার অঞ্চলকে পাড়ি দিয়েছে, যেখানে প্লাজমার ঘনত্ব সৌরজগত থেকে ৪০ গুণ বেশি। সূর্যের সর্ববহিঃস্থন্তর সৌর মুকুট তথা করােনা থেকে সৌর প্রবাহের কণাসমূহ সেকেন্ডে৩০০-৮০০ কিলােমিটার বেগে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
সূর্যের অভ্যন্তরীণ প্লাজমা; image: wikipedia

পরবর্তীতে এই কণাসমূহ আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলে ধীরে ধীরে বেগ হারিয়ে ফেলে। সৌরজগতের বাইরে যে বিন্দুতে বা অঞ্চলে সৌর প্রবাহের বেগ শব্দের বেগের চেয়ে ধীর হয়, সেই অঞ্চলকে বলা হয় টার্মিনেশন শক বা চূড়ান্ত ধাক্কা। এই অঞ্চলে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ সুপারসনিক থেকেসাবসনিক (শব্দের চেয়ে কম বেগ) হয়। পরবর্তীতে এই সৌর প্রবাহের বেগ ধীরে ধীরে। আরও কমতে থাকে। সর্বশেষ হেলিওপজ অঞ্চলে সৌর প্রবাহের চাপ ও আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের চাপ সাম্যাবস্থা লাভ করে।

টার্মিনেশন শক অঞ্চলটি ২০০৪ সালে ভয়েজার-১এবং ২০০৭ সালে ভয়েজার-২ অনুপ্রস্থভাবে পাড়ি দিয়েছিলাে। হেলিওস্ফিয়ারের গঠন টার্মিনেশন শকযে বিন্দুতে সৌর বায়ু স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের সাথে ক্রিয়া করা শুরু করে এবং এর গতি কমে যায়, সেই অঞ্চলকে বলা হয় টার্মিনেশন শক। এই অঞ্চলে সৌর বায়ু প্রবাহের বেগ সুপারসনিক থেকে সাবসনিক হয়।

image: wikipedia

হেলিওশিথ হেলিওপজ ও টার্মিনেশন শকের মধ্যে এই অঞ্চলটি অবস্থিত। এখানে সৌর বায়ুর বেগ অনেক কমে যায় ও সৌর বায়ু সংকুচিত হয় । আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের সাথে ক্রিয়া করে বলে এমনটি ঘটে।হেলিওপজ সৌর বায়ু যে অঞ্চলে গিয়ে নাক্ষত্রিক বায়ুকে বাধা দিতে পারে না বা বেগ শূন্য হয়ে যায়, সেই অঞ্চলটিই হেলিওপজ নামে পরিচিত হেলিওটেইল। যখন হেলিওস্কিয়ার আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় নদীতে চলমান নৌকার পানি লেজের মতাে তৈরি করে অগ্রসর হয়। এরই নাম হেলিওটেইল।


This is a bengali article. Here the boundaries of the solar system and plasma are described.

All the reference are hyperlinked within article.

Featured Image: bigganbd

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

চুম্বক: মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ আবিষ্কার

Next Article

বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ ভুটান

Related Posts

টমাস আলভা এডিসন: যার আবিস্কৃত আলোয় আলোকিত বিশ্ব

টমাস আলভা এডিসন। একজন মার্কিন বিজ্ঞানী। টমাস এডিসনের নাম শুনেনি এমন লোক খোঁজে মেলা ভার। বৈদ্যুতিক বাতি, কিন্টোগ্রাফ,…
আরও পড়ুন

বিদ্যুৎ কিভাবে আবিষ্কার হলো?

সূচিপত্র Hide জেনারেটর কী?জেনারেটরের গঠনজেনারেটর কীভাবে কাজ করে? ১৭৯১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ইংল্যান্ডে নিউইংটন বাটস অঞ্চলে কামার পরিবারে…

ব্লু অরিজিন : জেফ বেজোসের স্পেস ফ্লাইট কোম্পানি [পর্ব – ১]

ব্যয়বহুল, পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব নয় এমন রকেটগুলো এখন ইতিহাস৷ ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য এখানকার ভারী ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে মহাশূন্যে নিয়ে…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share