দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই মূলত বিশ্বজুড়ে আমেরিকার প্রভাব স্থায়ী রুপ লাভ করে। ১৯৪৫ সালে ২৪শে অক্টোবর ৫১টি দেশের অংশগ্রহণে আমেরিকার উদ্যোগে গঠিত হয় জাতিসংঘ। এই জাতিসংঘ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে গঠিত সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন হলেও এটিই যুদ্ধের পর সৃষ্টি হওয়া একমাত্র সংগঠন নয়।
১৯৪৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ২২শে জুলাই পর্যন্ত মিত্রপক্ষের ৪৪টি দেশের মোট ৭৩০জন প্রতিনিধি নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি ক্ষুদ্র অবকাশ যাপন কেন্দ্রে আলোচনার টেবিলে বসেন৷ তাদের লক্ষ্য ছিলো এমন একটি সার্বজনীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যেটি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বা অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করবে।ব্রেটন উডস কনফারেন্সনামে পরিচিত এই সভায় একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যাব্রেটন উডস এগ্রিমেন্টনামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এই চুক্তিই পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মেরুদন্ডে পরিণত হয়। এই সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৪ সালেবিশ্ব ব্যাংকএবংআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)গঠিত হয়।
এই সংস্থাসমূহ সৃষ্টির মাধ্যমে আমেরিকা বৈশ্বিক সমস্যাবলির সাথে ওতপ্রোতভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর দেশ রাশিয়া। এসব ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ভিন্ন। ২য় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বিরোধী সংগ্রাম গণতান্ত্রিক পশ্চিম ইউরোপ এবং কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপের মধ্যে বন্ধুত্বের মনোভাব সৃষ্টি করে। কিন্তু এই সদ্ভাব ছিলো সাময়িক।
পূর্ব ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে সোভিয়েত এবং কমিউনিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণকে আমেরিকা তাদের মুক্ত বাজার অর্থনীতির ভিত্তিতে চলা গণতান্ত্রিক বিশ্বের স্বপ্নের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে। পশ্চিম ইউরোপের সাথে সোভিয়েতরা কেমন আচরণ করবে এই ব্যাপারে ভীতির কারণে কানাডা, আমেরিকা এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ মিলে ১৯৪৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসিতে গঠন করেনর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)।এই সামরিক জোটের লক্ষ্য হলো রাশিয়া যেন অন্য কোন দেশে আক্রমণ চালাতে না পারে তা নিশ্চিত করা। প্রতিষ্ঠাকালে এই জোটের সদস্য সংখ্যা ছিলো ১২। বর্তমানে মোট ৩০টি দেশ এই সংগঠনের সদস্য। পুরো বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব ছড়িয়ে পড়া রোধে বিশ্বব্যাপী আমেরিকা যে কৌশল অবলম্বন করে তার নাম‘কন্টেইনমেন্ট’বা নিয়ন্ত্রণ। এই কৌশলের নাম এমন হওয়ার কারণ এর লক্ষ্যই ছিলো সোভিয়েত ভাবধারা এবং কমিউনিজমের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা।
কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই সংগ্রাম সর্বদা চলমান। তাই কন্টেইনমেন্ট নীতির সর্বদা প্রয়োগের জন্য আমেরিকাকে সবসময় পুরো বিশ্বে নিজের প্রভাব সংহত রাখতে হয়৷ এই কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তারা যে সামরিক যন্ত্র তৈরী করেছিলো, তার চাকা আর কখনোই বন্ধ হয়নি; বরং চলেছে দ্বিগুণ গতিতে।
বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমকে রোধ করতে এবং নিজেদের প্রভাবকে বলবৎ রাখতে আমেরিকাকে যেসকল কর্মসূচি হাতে নিতে হয়েছে, তার সরাসরি ফলাফল ২টি। এক, তাদেরকে সৌদি আরব, ইজরায়েল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশের সাথে অসম মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়েছে। কারণ আমেরিকার নীতি নির্ধারকদের মনে হয়েছে এই দেশগুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে তারা তাদের এলাকায় কমিউনিজমের সম্প্রসারণ রুখতে পারবে। এবং দুই, সোভিয়েত প্রভাব রোধে আমেরিকা অনেকসময়ই গোপনে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাতে শুরু করে এবং ঐসকল দেশের ভেতর অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ইরানের মত বেশকিছু দেশে তারা নিজেদের হাতের পুতুল অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ক্ষমতার মসনদ সংহত করতেও পিছপা হয়নি। এছাড়া তারা যেসব দেশে সরকার প্রধান বা সামরিক বাহিনীকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে পারেনি, সেসব দেশে বিদ্রোহীদের লেলিয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরুপ ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে এবং ১৯৮৫ সালে নিকারাগুয়ায় তাদের ভূমিকার কথা বলা যায়৷ যখন তারা মুজাহিদীন এবং কন্ট্রা নামক নৃশংস বিদ্রোহী দুটি গ্রুপকে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে দেশের ভেতর অচলাবস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমেরিকা অসংখ্য বৈশ্বিক কোন্দলে নাক গলায়। ফলে স্নায়ুযুদ্ধ শেষে দেখা যায় বিশ্বের প্রতিটি কোণায় বিভিন্ন দেশের সাথে তাদের বিভিন্ন ধরণের স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সাথে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতায় ভরা মৈত্রী এবং নানা দ্বন্দ্বের। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলমান ভিয়েতনাম যুদ্ধ তাদের দেশে এবং দেশের বাইরে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে।
১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর বার্লিন দেওয়ালের পতন হয়। বিশ্ব ইতিহাসে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। এতে করে ইউরোপকে দুই ভাগে বিভক্তকারী রাজনৈতিক সীমানা‘আয়রন কার্টেইন’এরও পতন হয়। যার ফলে পূর্ব এবং মধ্য ইউরোপে কমিউনিজমের প্রভাব কমতে শুরু করে। এসময় মিত্রদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে জটিল এই সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিলো আমেরিকার হাতে। তারা সামরিক ব্যয়ও কমিয়ে ফেলতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেনি। সামরিক খাতে খরচ কিছুটা কমালেও স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার সামরিক পরিকাঠামো এবং মৈত্রী এখনও বিদ্যমান। প্রেসিডেন্টজর্জ ডব্লিউ বুশএবংবিল ক্লিনটনউভয়ই এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন যে, ‘যদি তারা বৈশ্বিক ঘটনাবলীর তদারক করেন; তাতে আমেরিকা এবং পৃথিবী উভয়েরই মঙ্গল হবে।’
একসময়ের শত্রু জাপানের সাথেও সুসম্পর্ক তৈরী করেছে আমেরিকার। তাদের সাহায্যে ঐ অঞ্চলে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রুখে দিতে পারবে বলে তাদের বিশ্বাস। স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার রুখতে তৈরী হওয়া জোটগুলোও রয়েছে বহাল তবিয়তে, বরং এগুলোর সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং সুসংহত হয়েছে। ২০০১ সালে সংঘটিত নাইন ইলেভেন হামলার পর থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের নামে পুরো বিশ্বে আমেরিকার খবরদারি ও সাম্রাজ্যবাদী আচরণ কেবল বেড়েই চলেছে। ঐ হামলার পর থেকে তারা একের পর এক সামরিক ঘাঁটি গেঁড়েছে বিভিন্ন দেশে। ২০০১ সালের পর থেকে তাদের এ ধরণের আচরণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলিম দেশসমূহ এবং এগুলোর জনগণ। উগ্রবাদী মতবাদের পাশাপাশি তাদের এসব আচরণের কারণেও কিন্তু উল্টো অনেক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে।
সুপার পাওয়ার হতে গিয়ে আমেরিকাকে তাদের জনগণের সুবিধার কথাও ভাবতে হয়েছে অবশ্যই। সেদেশের জনগণ বেকার ভাতা, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা এবং মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে নানা সমস্যা থাকলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের দেশের অবস্থা ভালো। একসময় ‘নীচু’ জাতের সাথে চলতে হবে বলে ভৌগোলিক সীমানার সম্প্রসারণে অনাগ্রহী দেশটিই এখন অনেক মেধাবী ছাত্রকে বৃত্তি এবং কর্মসংস্থানের সুবিধা দিয়ে সে দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এদের অনেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। যার ফলে জ্ঞান এবং উদ্ভাবনী শক্তির কোন কমতি হয় না।
১৯৬৯ সালের ২০শে জুন তারা চন্দ্র বিজয়ের মাধ্যমে নিজেদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কথা জানান দেয়। বর্তমানেও এই ক্ষেত্রে তারা সেরা। তাদের আছে অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, টেসলার মত টেক জায়ান্ট। ফলে ভোগবাদে নেশাগ্রস্ত মানুষের মনে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আমেরিকান পণ্যই সেরা পণ্য। এছাড়া স্পেস এক্স এবং ব্লু অরিজিনের মত কোম্পানিগুলো অন্য গ্রহে কলোনি স্থাপনের কথাও ভাবছে। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে তারা পৃথিবীর যেকোন দেশে অবস্থানকারী মানুষজনের তথ্য জানতে সক্ষম। তাদের কাছে যে অস্ত্র এবং তেল মজুদ রয়েছে তার সাহায্য তারা যেকোন যুদ্ধে বিজয়ী হতে সক্ষম। কৃত্রিম উপগ্রহসহ তাদের বিভিন্ন নজরদারি যন্ত্রের সক্ষমতা কেমন তা অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের মত হুইসেল ব্লোয়ারদের মাধ্যমে জানতে পেরেছে বিশ্ব। তাই যেকোন ক্ষেত্রে অন্য দেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের পছন্দমত তাদেরকে চলতে বাধ্য করা তাদের পক্ষে অনেকটাই সহজ। এছাড়া সংগীত, সাহিত্য এবং সিনেমার দিক থেকেও তারা বিশ্বে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। মিডিয়ায়ও তাদের ভাষ্যই প্রকাশিত হয়। যা জনমত সৃষ্টিতে রাখে ব্যাপক ভূমিকা। তাই বর্তমানে আমেরিকান প্রভাবের বাইরে বিশ্ব কল্পনা করা একটু কষ্টসাধ্যই।
সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া ১৯৪৫ সাল থেকে সে দেশের কোন রাজনীতিবিদ বিশ্বে আমেরিকা যে ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে কোন কথা বলেননি। ট্রাম্পের মত ছিলো মিত্ররা আমেরিকাকে সুবিধার বিনিময়ে পর্যাপ্ত অর্থ দিচ্ছে না। যার ফলে তিনি জোটগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেন। তবে জো বাইডেনের আগমনে সবকিছু আগের মতই চলবে বলে ধারণা করা যায়৷ বর্তমানে চীন তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। রাশিয়াকে ধরাশায়ী করা আমেরিকা চীনের সাথে দ্বন্দ্বে কেমন করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
This is a Bangla article. The article is about how America Became A Superpower.
All the necessary links are hyperlinked.
Featured images are collected from Google.