লিখুন
ফলো

উইঘুর নির্যাতন: একুশ শতকের ভয়াবহ গণহত্যায় নিরব কেন বিশ্ব?

উইঘুর মুসলিমদের ওপর আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালাচ্ছে কমিউনিস্ট চীন। গণহত্যা এবং নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি ভয়ঙ্কর যা হয়তো আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসিদের চাইতেও এই গণহত্যা অনেক বেশি হিসেবী। আরো বেশি পরিপাটি চীনের এই জঘন্য আগ্রাসন।

তুরস্কে উইঘুর নির্যাতনের প্রতিবাদ সভা; image: anadolu agency

বৌদ্ধ ও অধার্মিক অধ্যুষিত চীনের পূর্ব তুর্কিস্তান (শিনজিয়াং) প্রদেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অঞ্চলে দীর্ঘ কয়েক শতক ধরে বসবাস করে আসছে তুর্কি উইঘুর এবং কাযাখ মুসলিমরা। তাদের রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বকীয় সমাজ ব্যবস্থা। চীনাদের সাথে তাদের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই, মিল আছে তুর্কি মুসলমানদের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে যখন গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠন করা হয় তখন পূর্ব তুর্কিস্তানকে নিজেদের বলে ঘোষণা দেয় তারা। এরপর থেকে এই অঞ্চলটিকে কার্যত পেশি শক্তি দ্বারা দখল করে রেখেছে চীন।

প্রায় ১৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলটি স্বাধীন হলে আকারে পৃথিবীর ১৮ তম বৃহত্তম রাষ্ট্র হতো। আর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে হতো সপ্তম বৃহত্তম দেশ। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাকৃতিকভাবে অপরূপ সৌন্দর্যময়। প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদেও অঞ্চলটি সমৃদ্ধ। ছবির মতো সুন্দর এই দেশের জনসংখ্যা আড়াই কোটিরও বেশি।

পূর্ব তুর্কিস্তান হচ্ছে চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ; image: world map

ত্রিশ লক্ষ মানুষ বন্দী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। চলছে অমানুষিক নির্যাতন, গণধর্ষণ। শ্রমদাসত্ব, মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট। জোরপূর্বক গর্ভপাত অর্গান হারভেস্টিং, মানুষের বিকিকিনি…গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্ছিদ্র পুলিশি রাষ্ট্র। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্তের নেশা ধরা দাঁতালো পুলিশ। আর ৫০০ মিটার পরপর রোডব্লক। পুরো রাজ্যজুড়ে ৬৩ কোটি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। অথচ সে রাজ্যের মোট জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। সিসিটিভি বসানো হয়েছে তাদের ঘরের মধ্যেও।

অত্যাধুনিক এই ক্যামেরাগুলো মানুষের ফেস ডিটেক্ট করতে সক্ষম। বলে দিতে পারে সনাক্তকৃত ব্যক্তির বয়স, ঠিকানা, পেশা এবং অতীতের সমস্ত রেকর্ড। হাটা-চলাতে সামান্য পরিবর্তন দেখা গেলই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। পাঠিয়ে দিবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নামক জীবন্ত নরকে। বেঁচে ফিরে আসা তো দূরের কথা, সেখান মানুষ নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করে।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক নির্যাতন, ধর্ষণ আর মগজ ধোলাইয়ের শিকার হচ্ছেন বন্দীরা। বন্দীদের বাধ্য করা হচ্ছে মুসলিম-উইঘুর পরিচয় এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করতে। পাশাপাশি বাধ্য করা হচ্ছে সমাজতন্ত্র, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের গুণগান গাইতে। রীতিমতো নিয়ম করে প্রতিদিন কাল্পনিক অপরাধের স্বীকারোক্তি আর প্রশংসা সংগীত আওড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে বন্দীদের। যারা তুলনামূলক ভাগ্যবান, তাদের শ্রমদাস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে। উইঘুরদের রক্ত আর অশ্রু মাখা শ্রমে তৈরি হচ্ছে নাইকি, অ্যাপল, অ্যাডিডাস ক্যালভিন ক্লাইন, গ্যাপ, ফক্সওয়াগ্যানের মতো বিশ্বখ্যাত অসংখ্য কোম্পানির ঝা চকচকে পণ্য।

উইঘুর নির্যাতনের এই চিত্রটি ২০১৮ সালে আলজাজিরাতে প্রকাশিত হলে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে; image: Al Jazeera

বাকিদের শিকার হতে হচ্ছে ইলেকট্রিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ‘টাইগার চেয়ার’, স্ট্রেস পজিশনসহ নানা ধরনের নির্যাতনের। ব্যাপক মাত্রায় চলছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ। চালানো হচ্ছে বিভিন্ন মেডিকেল এক্সপেরিমেন্ট। দেওয়া হচ্ছে অজানা ইনজেকশন। নারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো হচ্ছে। নারী ও পুরুষ, উভয়ে শিকার হচ্ছে জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ ও নির্বীজনের। হিসেবী নিষ্ঠুরতায় বন্দি উইঘুরদের শরীর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে চীন গড়ে তুলেছে অর্গান ট্রেডের এক বিশাল, রমরমা মার্কেট।

সহকারী লাইসেন্স নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে “হান আত্মীয়” নামক এক জাতীয় ধর্ষক। Pair Up and Become Family Program এর আওতায় উইঘুরদের ঘরের মধ্যে কাল্পনিক আত্মীয় নামক ধর্ষকদের পাঠিয়েছে চীন। এরা প্রতিটি ঘরে অবস্থান নিয়ে উইঘুরদের প্রতিটি কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করছে। শুকুরের মাংস ও মদ খেতে বাধ্য করছে। আর গণহারে ধর্ষণ করছে উইঘুর নারীদের। ভুলিয়ে দিচ্ছে উইঘুরদের ধর্ম ও সংস্কৃতি। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে চীন সরকার উইঘুর ঘরগুলোকে কারাগারে পরিণত করেছে। এমন এক কারাগার, যে কারাগার থেকে কোন উইঘুরের মুক্তি নেই। মূলত ১৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের পূর্ব তুর্কিস্তান পুরোটাই এক কারাগার, এক গোরস্থান!

Image source: CCTV News

গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে অগণিত মসজিদ আর কবরস্থান। নামাজ নিষিদ্ধ। রোযা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ দাড়ি, হিজাব, এমনকি আরবি বর্ণমালাও। বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ, বিদেশে আত্মীয় থাকা নিষিদ্ধ, বিদেশে কারো সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ পালিয়ে হজ্জ্ব করাও। ঘোষণা দিয়ে বিকৃত করা হচ্ছে কুরআন।

…না। এটা অতীতের কোনো গল্প না। ভবিষ্যতের কোনো কল্পকাহিনী না। আমাদের বর্তমানের কথা। পূর্ব তুর্কিস্তানের (শিনজিয়াং) আড়াই কোটি মুসলিমের জীবনের কথা। নিরবতার প্রাচীরের আড়ালে উইঘুর-কাযাখ মুসলিমদের উপর চালানো চীনের জেনোসাইডের কথা।

অকেজো বিশ্বব্যবস্থা আর জাতিরাষ্ট্রের সীমানায় আটকে ধুঁকে ধুঁকে মরা উম্মাহর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পুর্ব তুর্কিস্তানে নির্বিঘ্ন গণহত্যা চালাচ্ছে চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসিদের চাইতেও অনেক হিসেবী এই গনহত্যা। আরো অনেক পরিপাটি চীনের এই আগ্রাসন। তথ্যপ্রযুক্তির আড়ালে চাপা পড়া এই নৃশংস গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের কতটুকুই বা জানার সুযোগ হয়েছে!

উইঘুরদের এই করুণ দুর্দশায় বিশ্ব মোড়লরা আজ নীরব। নীরব মুসলিম বিশ্বও। জাতিসংঘ দুবেলা নিয়ম করে “আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন” বলে দায় সেরেছে। দুঃজনক বিষয় হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলো থেকে উইঘুর ছাত্রদের জোর করে তুলে দেওয়া হচ্ছে চীনের হাতে। মিশর, মালয়েশিয়া, সৌদিআরব, পাকিস্তান অসংখ্য উইঘুরদের রক্ত পিপাসু চীনের হাতে তুলে দিয়েছে।

Image source: Anadolu Agency

উইঘুর নির্যাতনের প্রতিবাদে চীনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব করা হলে নব্য ক্রুসেডার অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্সের মতো ২৭টি দেশ সেখানে স্বাক্ষর করেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, একটা মুসলিম দেশ সেখানে স্বাক্ষর করেনি। শুধু এখানেই শেষ নয়, ঔ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীনের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়ে ৩৬টি দেশ একটি প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করে। সেখানে মুসলিম বিশ্বের অভিভাবক সৌদি, পাকিস্তান, আমিরাত, বাইরাইন, ওমান, কাতার নির্দ্বিধায় স্বাক্ষর করে দিয়েছে।

সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান চীন সফরে শি জিনপিং এর সাথে আনন্দ ভরা হাসি মুখে সেলফি তুলে বলেছে “উইঘুররা চীনে খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছে।” সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে ইমরান খান বলেছেন তিনি উইঘুরদের সম্পর্কে কিছু জানেন না এবং এ বিষয়ে কিছু বলতেও চান না।

চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে হাসিমুখে সৌদির যুবরাজ; image source: Anadolu Agency

অন্যদিকে আমরা চেয়ে আছি তুরস্কের প্রতি, হয়ত আর কিছুদিন পরেই তুরস্ক খেলাফতের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে, তখন আর মুসলিমদের কোনো দুর্দশা থাকবে না। সুলতান এরদোয়ান সারাবিশ্বের মুসলিমের পাশে অবিভাবকের মতো দাঁড়াবেন। কিন্তু সেই এরদোয়ানও উইঘুরদের পাশে দাঁড়ায়নি। অসংখ্য উইঘুরকে জোরপূর্বক চীনের হাতে তুলে দিয়েছে। আর চীন এখন তাদের অতিথি আপ্যায়ন করছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে।

সৌদিতে চীনের পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। চীনের সাথে তাদের বাণিজ্য ৬৩ বিলিয়ন ডলারের। অন্যদিকে চীন সফরে যেয়ে এরদোয়ান চীনের ব্যবসায়িদের তুরস্কে বিনিয়োগের জন্য আহবান জানিয়েছেন। এই বাণিজ্য তিনি ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে যান। “সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী” দমনে চীনের প্রসংশা করেন তিনি। তিনি একথাও জানিয়েছেন যে তুরস্ক একক চীনে বিশ্বাসী।

এখানেই শেষ নয়, তুরস্কের পার্লামেন্টে বিরোধী দলগুলো থেকে চীনের নিন্দা প্রস্তাব করা হলে এরদোয়ানের একে পার্টি এর বিপক্ষে ভোট দিয়ে নিন্দা প্রস্তাব বানচাল করে দিয়েছে। ইসরায়েলে আগুন লাগলে ইস্তাম্বুল থেকে আকাশে বিমান উড়ে, অথচ ধুকে ধুকে মরা স্বজাতি উইঘুরদের জন্য এরদোয়ানের হাত প্রসারিত হলো না। দু-একটি নমনীয় কথা ছাড়া পুরোটা সময় এরদোয়ান উইঘুদের বিষয়ে নীরবতা পালন করেছেন।

চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান; image: Anadolu Agency

একুশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং উপেক্ষিত গণহত্যার শিকার মানুষদের অশ্রু, রক্ত, জীবন আর মৃত্যুর আজ কোনো মূল্য নেই। মানবতার ফাঁকা বুলিতে তাদের আর্তনাদ আর আহাজারি মিলিয়ে গেছে।

ওআইসির মত একটি ইসলামিক সংগঠন নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি একটা শক্ত প্রতিবাদও করতে পারেনি চীনের বিরুদ্ধে। রহস্যময় কারণে নিরবতা নেমে এসেছে মিডিয়া পাড়া ও বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনেও। কিন্তু সময়ের দাবি পরিষ্কার। দায়িত্বকে এড়িয়ে গিয়ে নিরব নিভৃত বিড়ালপ্রবণতায় হয়তো জীবন কাটিয়ে দিতে পারব আমরা, কিন্তু ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

 


This is a Bengali article. It is about the horrific Uyghur genocide in the 21st century.

All necessary reference are hyperlinked inside article.

Total
0
Shares
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Previous Article

পারফিউমের ইতিহাস : প্রাচীন মেসোপোটেমীয় পণ্য যেভাবে তৈরী করলো বিলিয়ন ডলারের বাজার

Related Posts

৫০০ কোভিড ভ্যাকসিন নষ্ট

মডার্নার ভ্যাকসিন আরো ব্যাপকভাবে বিতরণ করার মূল কারন হলো এটি স্বাভাবিক হিমায়িত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। ক্রেডিট- নিউ ইয়র্ক টাইমস উইসকনসিনের একটি হাসপাতালের একজন ফার্মাসিস্টকে…

সবচেয়ে বেশি কভিড আক্রান্ত দেশগুলো

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো তালিকার শীর্ষে রয়েছে, যেখানে মোট ১৪ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। মোট বৈশ্বিক সংখ্যা এখন ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি, যেখানে ১৫ লক্ষেরও বেশি লোক মারা গেছে।  This…

কিউএ্যানন এবং মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলার ইতিহাস

গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের আদিভূমি বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক গণতন্ত্র চর্চা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য অনুকরণীয়। বিশ্বের…

আমাদের নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করুন

Total
0
Share